ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও হস্তরেখাবিদ্যা এবং কোরআনের দুটি আয়াত।

হস্তরেখাবিদ্যা অতিপ্রাচীন বিদ্যাসমূহের একটি। হস্তরেখাবিদ্যার সত্যতার প্রমান প্রত্যেকটি মানুষ নিজেই দিয়ে থাকে তার সমগ্র জীবনে। কিন্তু তা বুঝতে হলে হস্তরেখাবিদ্যার কিছুটা হলেও জ্ঞান থাকতে হবে। হস্তরেখাবিদ্যার সত্যতার সমর্থন যে পবিত্র কোরআন থেকেই পাওয়া যায় সেটিই আমার আলোচ্য বিষয়। কিন্তু তার আগে ইদানিং বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত “বায়োমেট্রিক” শব্দটির সাথে আরও একটু পরিচিত হওয়া দরকার। যদিও আমরা মোবাইল সিম নিবন্ধনের প্রয়োজনে ইদানিং তার সাথে বেশ অনেকটাই পরিচিত হয়েছি। বিজ্ঞানের যে শাখায় মানুষের ভৌতিক গুণাবলীর উপর ভিত্তি করে মানুষকে সনাক্ত করা যায় তাকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বলা হয়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি হচ্ছে বায়োমেট্রিক এর একটি শাখা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তিতে আঙ্গুলের ছাপের উপর ভিত্তি করে কাউকে সনাক্ত করা হয়। মানুষের গঠন, চলনভঙ্গী, কণ্ঠস্বর, মুখমন্ডল, স্বাক্ষর, এসব সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন বা নকল করা হতে পারে বিধায় কাউকে সনাক্তকরণে এগুলোর উপর নির্ভর করা যায় না। অন্যদিকে প্রত্যেকটি মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পূর্ণই আলাদা এবং সারা জীবন ধরে অপরিবর্তিত থাকার কারণে অন্য যে কোন ফীচার-ভিত্তিক প্রযুক্তির চেয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট-ভিত্তিক প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে নির্ভুল ও কার্যকরী। উল্লেখ্য যে,- বিজ্ঞানীদের মতে এই আঙ্গুল এবং করতলের রেখার গঠন হয় মাতৃগর্ভের প্রথম তিন মাসেই। আর প্রতিটি ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্ট এতটাই স্বাতন্ত্র্য যে, দেখা গেছে দুটি যমজ শিশু একই ডিএনএ প্রোফাইল নিয়ে জন্মালেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে তাদের আলাদা করা যায়। অপরাধী সনাক্তকরণ ছাড়াও কারো প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করতে এর কোন বিকল্প নেই। এজন্যই মোবাইলফোনের সিম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন, ভোটার আইডিকার্ড, সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়, পাসপোর্ট, বিদেশ ভ্রমনের জন্য এবং ব্যাংক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি সহ স্মার্টফোনের সুরক্ষার জন্যও আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যাবহার করা হয়।finger-print-id-usdoj

এছাড়াও বিশ্বব্যাপী খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, প্রতারনা, কাউকে রক্তের সম্পর্কের আপনজন হিসেবে চালিয়ে দেয়া, নিজ সন্তানকে অস্বীকার করা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ড প্রতিনিয়ত সংঘটিত হয়েই চলছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা হাতেনাতে ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরী হয়ে পড়েছে। অপরাধী সনাক্তকরণের জন্য অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশ ও সমাজে বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি প্রয়োগ হয়ে আসছে। তবে অপরাধী সনাক্তকরণের আধুনিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি অন্যতম। কেননা প্রত্যেকটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ সম্পূর্ন ভিন্ন ভিন্ন। কোনও দুইজন মানুষের আঙ্গুলের ছাপ একই রকম হয়না। প্রতিটি মানুষ, মৃত কিংবা জীবিত প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের অনন্য আঙ্গুলের আঁকিবুকি রয়েছে। আর দুইজন মানুষের আঙ্গুলের ছাপের মধ্যে পার্থক্য এতই সূক্ষ্ম যে, কেবল অভিজ্ঞ ব্যক্তিই শুধু উপযুক্ত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে তা শনাক্ত করতে পারে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণা অনুযায়ী জিনের মধ্যে সন্নিবেশিত প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যই, যেমন- শারিরীক, মানসিক, স্বাস্থ্যগত, চারিত্রিক ইত্যাদি সবকিছুই আঙ্গুলের ছাপে এনকোড করা থাকে অর্থাৎ সাংকেতিক কোডের সাহায্যে লেখা রয়েছে। যাকে কম্পিউটার জগতে ব্যবহৃত রেখা-সঙ্কেত তথা  Bar-Code সিস্টেমের সঙ্গে তুলনা করা চলে মানুষের আঙ্গুলের এই সুচারু গঠনটিকে।। তাই ফিঙ্গারপ্রিন্ট অর্থাৎ আঙ্গুলের ছাপকে জিনের সংরক্ষিত তথ্যের মনিটর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জিনের বিকল্প কাজ শুধু মাত্র এই আঙ্গুলের ছাপ দিয়েই করা সম্ভব। সেজন্য তাকে ডাটা ব্যাংকও বলা হয়। আর তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে আঙ্গুলের রেখাসমূহকে মানুষের পরিচয়ের জন্য সন্দেহাতীতভাবে গ্রহন করে নেয়া হয়েছে সারা দুনিয়ায় এবং বহুমাত্রিক উদ্দেশ্যেই তা পৃথিবীর সর্বত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এজন্যই ক্রাইম ইনভেষ্টিগেশনের একটি গুরুত্বপূর্ন উপায় হলো আঙ্গুলের ছাপ। এই আঙ্গুলের ছাপের মাধ্যমে পৃথিবীর বড় বড় গোয়েন্দা সংস্থা যেমন- FBI, CIA, KGB, RAW, MOSAD প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করতে সমর্থ হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগও অপরাধী চিহ্নিতকরনের লক্ষ্যে এই টেকনোলজী ব্যবহার করছে।130px-fingerprintforcriminologystubs2 150px-fingerprint_whorl consultations

এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি ১৬৮৪ সালে সর্ব প্রথম ইংরেজ চিকিৎসক, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং অনুবীক্ষন যন্ত্রবিদ নিহিমিয়া গ্রিউ (Dr. Nehemiah Grew ১৬৪৭-১৭১২) বৈজ্ঞানিক দৈনিকী প্রকাশ করে করতল ও আঙ্গুলের ছাপের রহস্যের সংযোগ সূত্রের ধারণার উত্থাপন করেন। এরপর ১৬৮৫ সালে ডাচ চিকিৎসক গোভার্ড বিডলো (১৬৪৯-১৭১৩) এবং ইটালিয়ান বিজ্ঞানী মারসিলো (Marcello Malpighi ১৬২৮-১৬৯৪) এনাটমির ওপর বই প্রকাশ করে ফিঙ্গার প্রিন্টের ইউনিক গঠনের উপর আলোচনা উত্থাপন করেন। ১৬৮৪ সালের পূর্বে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পর্কে আর কারো কোনো আলোকপাতের কথা পাওয়া যায় না। পরবর্তীতে ১৮০০ সালের পর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পুনরায় জোরালোভাবে বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। এসব বিজ্ঞানীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ১৮৭৫ সালে জেন জিন্সেন, বাংলাদেশের খুলনার সৈয়দ মুহাম্মাদ কাজী আজিজুল হক, ব্রিটিশ কর্মকর্তা এডওয়ার্ড হেনরি এবং ইংল্যান্ডের অধিবাসী স্যার ফ্রান্সিস গোল্ড। তারা আবিষ্কার করেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ ভিন্ন ভিন্ন রকম। যুগান্তকারী এ আবিষ্কারের পর অর্থাৎ ১৮৮০ সাল হতেই আঙ্গুলের ছাপ একটি বৈজ্ঞানিক সনাক্তকরন সংকেতরূপে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। তার আগে ফিঙ্গারপ্রিন্টের গভীরতম তাৎপর্যের প্রতি তেমন কেউ ভ্রুক্ষেপ করেনি। যদিও হস্তরেখাবিদ্যা অতিপ্রাচীন কাল হতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিভিন্ন প্যাটার্ন অনুযায়ী মানুষের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করে আসছে।course-jozi

এখন দেখব হস্তরেখাবিদ্যা সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কি বলে। পবিত্র কোরআনে আজ থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ যখন কোরআনে বার বার বিচার দিবস ও পুনরুত্থানের কথা বলেছেন তখন কাফিররা এই বলে হাসাহাসি করতো যে পচা গলা হাড় গুলোকে কিভাবে একত্রিত করা হবে? একজনের অস্থির সঙ্গে অন্যজনের গুলো বদলি হবে না? যেমন-, সূরা বনী ইসরাইলের ৪৯ আয়াতে- আর তারা বলে-“কি! আমরা যখন হাড্ডি ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখন কি আমরা নতুন সৃষ্টিতে পুনরুথ্থিত হব?” একই সূরার ৯৮ আয়াতে- এই হচ্ছে তাদের প্রতিদান কেননা তারা আমাদের নির্দেশাবলী অস্বীকার করেছিল এবং বলেছিল- “কী! আমরা যখন হাড় ও ধুলোকণা হয়ে যাব তখন কি আমরা সত্যই পুনরুথ্থিত হব নতুন সৃষ্টিরূপে?” সূরা আল-মু’মিনুন ৮২ আয়াতে- তারা বললে- “কি! আমরা যখন মরে যাই এবং ধুলো-মাটি ও হাড়-পাঁজরাতে পরিণত হই, তখন কি আমরা ঠিক ঠিকই পুনরুথ্থিত হব?” আবার সূরা ইয়সিনের ৭৮ আয়াতে বলা হয়েছে- আর সে আমাদের সদৃশ বানায়, আর ভুলে যায় তার নিজের সৃষ্টির কথা। সে বলে- “হাড়-গোড়ের মধ্যে কে প্রাণ দেবে যখন তা গলে-পচে যাবে?”discover-your-unique-fingerprint

কাফিরদের সেসব কথার জবাবে পবিত্র কোরআনের ২৯ পাড়ায় সূরা আল্-কিয়ামাহ্-এর ৩ ও ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,- “আইয়াহ্ সাবুল্ ইন্সা-নু আল্লান্ নাজ্ব মা’আ ই’জোয়া-মাহ্। বালা-ক্ব-দিরীনা ‘আলা- আন্ নুসাওয়্যিয়া বানা-নাহ্।” অর্থাৎ “মানুষ কি মনে করে যে আমরা কখনো তার হাড়গোড় একত্রিত করব না? হাঁ, আমরা তার আঙ্গুলগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।” আল্লাহ শুধু মানুষের অস্থিতে মাংশ পড়িয়ে অবিকল দেহ দিয়েই উত্থিত করবেন না বরং এমন নিখুঁতভাবে মানুষকে জীবিত করবেন যেমন জীবদ্দশায় তার আঙ্গুলের সূক্ষ্ম রেখা পর্যন্ত সুবিন্যস্থ ছিল ঠিক তেমনিভাবে। এখানে কাফিরদের অভিযোগেরও উত্তর দেওয়া আছে। কাফিররা বলেছিল পচা গলা অস্থিগুলো একজনের সাথে অন্যজনের গুলো মিশ্রিত হবে না? তাই আল্লাহ এখানে কাফিরদের জবাব ও জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন দিয়েছেন যে,- শুধু মাত্র আঙ্গুলের প্যাটার্ন দিয়েই যদি একটি মানুষের সম্যক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব হয় যা আল্লাহ নিজেই প্রথম সৃষ্টি করার সময় দিয়েছেন, সেই আল্লাহর পক্ষে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের অস্থি দিয়ে পুনঃবিন্যস্থ করা এবং আঙ্গুলের সূক্ষ্ম রেখা পর্যন্ত সুবিন্যস্থ করা অবশ্যই সম্ভব, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।fingerprint-assessment

এখন ভেবে দেখার বিষয় যে,- আল্লাহপাক পায়েরপাতা কিংবা মাথার চাঁদি পর্যন্ত না বলে “আঙ্গুলগুলো পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম” বলে আঙ্গুলের প্রাধান্য দিয়েছেন কেন? তবে কি আঙ্গুলের মধ্যেই প্রত্যেকের আলাদা বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করার উপাদান আছে? কেননা মাথাতেই মানুষের মষ্তিষ্ক আর সেখানেই সকল স্নায়ূকেন্দ্র, যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা-সিদ্ধান্ত সহ সবকিছুই মাথা থেকে হয়, এককথায় মানবদেহের প্রধান অঙ্গ হল মাথা, সেই গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ মাথার কথা না বলে “আঙ্গুলগুলো পর্যন্ত” বলায়- এ কথাই কি সুস্পষ্ট হয়না যে,- মানুষের আঙ্গুলের প্যাটার্নের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং আঙ্গুলের প্যাটার্ন ব্যতীত মানুষের সম্পূর্ন গঠন যে সম্পন্ন হবেনা সেটিই জানাচ্ছেন মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। যা সেই সময়ে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি এবং আল্লাহ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি আমাদের গভীরভাবে মনোযোগ দেয়ার জন্য অনুপ্রানিত করেছেন এই কথা বলে। যে প্রয়োজনীয়তার কথা অবশেষে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছে সামান্য হলেও। এটি কোরআন মাজিদের অপর এক মুজিজা যে- তা এই বাস্তবতার বর্ণনা দিয়েছে মানুষ তা ধারণা করারও বহু আগে। ভাবুন একবার ১৪০০ বৎসর পূর্বে এই গুরুত্বপূর্ন তথ্য কার জানা ছিল? কেন তিনি এ তথ্য আমাদের দিলেন? আমি বলব,- নিশ্চয়ই অনর্থক দেননি। কোরআনে কোন কিছুই অনর্থক উল্লেখ হয়নি। এর অবশ্যই গুরুত্ব আছে। আর ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্যাটার্নই সেই গুরুত্বের দাবীদার যার কথা হস্তরেখাবিদ্যা অতিপ্রাচীন কাল থেকেই বলে আসছে এবং আজও মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য, দোষ-গুন, মানসিকতা, রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদসহ অন্যান্য বিষয় নির্ণয় ও সতর্ক করে মানবকল্যানে অবদান রাখছে।